বাংলাদেশের জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সারোয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘ডুব’ ছবিটি সেন্সর বোর্ড থেকে ছাড়পত্র পেলেও এর পিছনে আলোচনা ও সমালোচনা যেন রয়েই গেছে। এই ছবিকে বায়োপিক বলেও মন্তব্য করে যাচ্ছেন অনেকে। তাদের এসব ভুল ধারনা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে ছবিটির পরিচালক এক গণমাধ্যমে এই ব্যাপারে একটি বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
ফারুকীর লেখাটি হুবুহু তুলে ধরা হল-
‘ভাই! ট্রেইলারে তো মিল পাওয়া যাচ্ছে আমাদের প্রিয় লেখকের সঙ্গে। তাহলে আপনারা “বায়োপিক নয়” বলছেন কেন?’ এ রকম কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছেন।
যাদের সারা দুনিয়ার সিনেমা বা ওয়ার্ল্ড অব ফিকশন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে, তারা অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলছেন যে, এটা একটা অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক।
এটা শুধু অপ্রয়োজনীয় নয়, বেশ বালকসুলভও বটে। যাই হোক, যেহেতু আলোচনাটা উঠেছে, উত্তর তো দিতেই হবে। প্রথমেই খুব মোটা দাগের কয়টা কথা বলি।
ধরা যাক, আমি বললাম এটা বায়োপিক। তাতে কী দাঁড়াবে? বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছে এর অর্থ দাঁড়াবে, যাহা দেখিব, সত্য দেখিব। সত্য বই মিথ্যা দেখিব না।
আমি ‘বাংলাদেশের অনেক মানুষ’ বললাম এ কারণে যে, বাকিরা জানেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমনকি বায়োপিক নাম দিয়েও জীবনের হুবহু সত্য দেখায় না। এ বিষয়ে একটু পরে আসছি।
তার আগে আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। তো যারা আমার কাছে আশা করছেন, আমি যেন এটাকে বায়োপিক ডাকি, তাদের উদ্দেশে আমি বললাম, ওকে যান এটা বায়োপিক।
এখন তাদের পরের কথাটা কী হবে?
‘ভাই! এটা কীভাবে বায়োপিক হইল? অমুক আপা তো তমুক আপার সঙ্গে এক স্কুলে পড়ে নাই। উনি তো এই রকম রাতের বেলা ওয়াল টপকাইয়া দেখা করে নাই। এটা তো এই রকমভাবে বাস্তবে হয় নাই, ওই রকমভাবে হয়েছিল। এইভাবে বিয়ে হয় নাই, ওইভাবে হয়েছিল। ’
তো?
সেজন্যই তো আমরা এটাকে বায়োপিক বলছি না। বোঝা গেছে জিনিসটা?
কেবল এ রকম একটি-দুটি বিষয়ে নয়, অজস্র বিষয়ে আমি আমার কল্পনায় একটা ন্যারেটিভ খাড়া করেছি। যেটা তথ্যের সত্যের কোনো গ্যারান্টিই দেবে না। আমরা তো জানি আমরা সত্য হুবহু দেখাইনি। আমরা তো জানি আমরা ফিকশন বলছি। ডকুমেন্টেশন আমার কাজ নয়। ওটা ইতিহাস রচয়িতাদের কাজ।
সেখানেও কী বিপদ আছে দেখেন। কার ইতিহাস? প্রিয় লেখকের দ্বিতীয় বিয়ে, বিয়ে-পরবর্তী জীবন, অসুস্থতা, নিউইয়র্কের চিকিৎসাকালীন দিনগুলো, মৃত্যু, মৃত্যু-পরবর্তী দিনগুলো— এই মোটা দাগের অধ্যায়গুলোয় তার দ্বিতীয় স্ত্রী যে গান শোনাবেন তা কি প্রথম পরিবারের সঙ্গে একই সুরে বাজবে? বা ঘটনার অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে মিলবে? কোন ইতিহাস তাহলে রচিবেন ইতিহাসবিদ?
বা এমনকি ব্যক্তি নিজেও যদি লিখেন তা কতটা সত্যের নিশ্চয়তা দেয়? আমার জীবন নিয়ে যদি আমি লিখি তা তো শেষ পর্যন্ত আমার পার্সপেকটিভ। সেখানে সত্য কোনটা?
ফিকশন রাইটার তথ্যের সত্য খোঁজেন না। তিনি বাস্তবের রসদ নিয়ে এক কল্পনার জগৎ তৈরি করেন। এমনকি প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদও সারা জীবন এভাবেই কখনো নিজের বা কখনো অন্যের জীবন ছেনেই বের করেছেন গল্পের মধু। সেখানে তার প্রয়োজন পড়েনি সোর্স উল্লেখ করার। কেউ যদি মনে করেন সোর্স উল্লেখ করতে পারেন, আবার নাও করতে পারেন।
এমনকি যেখানে তিনি ইতিহাসের চরিত্রগুলোর নাম নিয়ে গল্প লিখেছেন ‘দেয়াল’, সেখানে কী হয়েছে? সেখানে কি তিনি সত্যের নিশ্চয়তা দিয়েছেন? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তোফায়েল আহমেদ ঝিমুচ্ছিলেন জাতীয় কিছু লিখেছেন উনি। এখন তোফায়েল সাহেব যদি বলেন, ‘প্রিয় হুমায়ূন! আপনি তো আমার নাম ব্যবহার করে মিথ্যা লিখেছেন, এটা প্রত্যাহার করুন। ’ তখন কী করণীয় হবে?
বাস্তবে কিন্তু তাকে বলাও হয়েছিল কতগুলো অধ্যায়ের অথেনটিসিটির অভাবের বিষয়ে।
কিন্তু তিনি পরিষ্কার ফিকশন রাইটারের লিবার্টি চেয়েছেন, তাই ঐতিহাসিক নাম উল্লেখ করে ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর লেখা উপন্যাসে নিজের মতো করে গল্প তৈরি করেছেন।
ফিকশন হচ্ছে বানোয়াট ন্যারেটিভ যা আপনাকে তথ্যের সত্যের নিশ্চয়তা দেবে না। দেবে রচয়িতার ইন্টারপ্রেটেশন।
যে রাবণ অন্যের কলমে অশুভশক্তি, মাইকেল মধুসূদন দত্তের কলমে তিনিই হয়ে ওঠেন নায়ক। আরও দশজনের কলমে ওই একই গল্প হয়ে যেতে পারে দশ রকম।
শুধু গল্পের দিকে না তাকিয়ে বাস্তবের দিকেই তাকাই একটু। বাস্তবে একই মানুষ সম্পর্কে দশজনের দশ রকম পারসেপশন দেখি না আমরা? একই লোক এর কাছে দয়ালু, আরেকজনের কাছে সুবিধাবাদী, আরেকজনের কাছে নির্বিবাদী হয় না? এই ভাবনা বা ব্যাখ্যা কি আমরা আটকাতে পারি?
তাহলে গল্পের কাল্পনিক জগতে হাজার রকম ইন্টারপ্রেটেশন আমরা আটকাব কীভাবে?
আমরা কি ভুলেই গেলাম গল্প তৈরি করা হয়, বানানো হয় রচয়িতার বয়ানে? হয়তো এই বানোয়াট গল্প আপনাকে জীবনের কোনো গভীরতর সত্যে পৌঁছাতে সাহায্য করলেও করতে পারে, কিন্তু তথ্যের সত্যের কোনো নিশ্চয়তাই সে আপনাকে দেবে না।
আমার ছবিও কোনো ‘তথ্যের সত্যে’র নিশ্চয়তা দেবে না। তবে কী দেবে? দিতে পারে জীবনের গভীর কোনো হাহাকারের খোঁজ, অনাদরে বেড়ে ওঠা কোনো আবেগের খোঁজ, অসহায় কোনো সত্যের খোঁজ যার বাড়ি তথ্যের সীমানার বাইরে।
এবার আসুন আলোচনা করি বায়োপিক নাম দিয়েও কীভাবে আপনাকে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়। এর আগে মার্ক জুকারবার্গের জীবন নিয়ে বানানো দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ছবি নিয়ে জুকারবার্গের প্রতিক্রিয়ার কথা লিখেছি অন্য এক লেখায়। যেখানে তিনি বলেছেন, ওই ছবিতে তার পোশাক ছাড়া আর কোনো কিছুই অথেনটিক নয়। কিন্তু এই ছবিটিই চিত্রনাট্যের জন্য অস্কার পেয়েছে। এ রকম উদাহরণ হাজার হাজার আছে। এতে কী বোঝা যায়? বোঝা যায়, গল্পের বৃক্ষ থেকে কেউ সত্য পাড়তে আসে না।
সাম্প্রতিক একটি আলোচিত উদাহরণ দিই। ফরাসি সিনেমায় প্রায় গডের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত চলচ্চিত্রকার জঁ লুক গোদারকে নিয়ে একটি ছবি বানিয়েছেন অস্কারজয়ী মিশেল হাজানিভিচুস। ছবির নাম ‘দ্য রিডাউটেবল’। কান কমপিটিশনে প্রিমিয়ার হওয়া এই ছবি এ বছর এল গোনা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অফিশিয়াল সিলেকশনে ছিল। ছবিটি আমার সেখানেই দেখার সুযোগ হয়েছে।
তো এ রকম প্রায় দেবতুল্য গোদারকে নিয়ে মিশেল কী বানালেন? একটি আধা হিউমারাস, আধা স্যাটায়ারিক্যাল, আধা ফ্যামিলি, আধা পলিটিক্যাল ড্রামা। এবং তাও সরাসরি গোদারের নাম ব্যবহার করে। ভিত্তি হিসেবে নিয়েছেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী আনার স্মৃতিকথা, যা কিনা গোদার আবার এনডোর্স করেন না বলেই ফরাসিদের বিশ্বাস। এখন এই ছবি বানাতে গিয়ে মিশেল কী করলেন, তিনি আনাকেও হুবহু কপি করতে চাইলেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন গোদার অনেক জন। একজন গোদার আছেন যাকে গোদার নিজে বানিয়েছেন। আরেক গোদার নির্মিত হয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী আনার বয়ানে। আর মিশেল আবিষ্কার করতে চেয়েছেন আরেক গোদার, তার নিজস্ব গোদার। গোদার এখনো জীবিত। সুইজারল্যান্ডের নিভৃত গ্রামে থাকেন। ফরাসিদের মতে, গোদার এই ছবিকে ভালোভাবে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এমনকি যারা গোদারকে কাছ থেকে চিনতেন, তারা ছবি দেখার পর থেকেই বিরক্ত কারণ গোদার নাকি মোটেও এ রকম ছিলেন না।
কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে এই গোদার থেকে যাবেন মিশেলের ভাষ্য হিসেবে, সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা না করেই। কারণ এটা গল্প, এটা শিল্পীর বানোয়াট ভাষ্য।
আমাদের গল্পে আমরা এসবের ধারেকাছেও যাইনি, নামও ব্যবহার করিনি, বায়োপিক তো বহু দূরের কথা। আমরা বাস্তব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছি, বাস্তবের পুনর্নির্মাণ করিনি।
এটা নিয়ে যদি তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ভয় থাকে, সেটা একান্তই তার সমস্যা। ফিকশন নির্মাতা তার প্রতি কেবল সহানুভূতিই জারি রাখতে পারেন, আর কিছু করা আসলে তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কারও সাম্রাজ্য রক্ষা বা ধ্বংস করা কোনোটাই ফিকশন নির্মাতার কাজ নয়, অভিপ্রায়ও নয়’।