‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ থেকে মৃত্যুমুখে! StarGolpo.com

167
পেশিবহুল শরীর তৈরির মাশুল গুনছেন দেবরাজ

‘আমাদের বডি হচ্ছে ওয়ার্ক অফ আর্ট। এটা মন্দির। আর এই মাসলগুলো তার মধ্যে সব কারুকার্য।’ সত্যজিৎ রায়ের ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) ছবিতে এভাবেই নিজের পেশিবহুল শরীরের বর্ণনা দিয়েছিলেন ব্যায়ামবীর গুণময় বাগচি। শরীরচর্চা কত বড় সাধনা, তা বুঝিয়েছিলেন লালমোহনবাবুকে। বড় বড় চোখে মুগ্ধ হয়ে তা শুনেছিলেন লালমোহনবাবু।

ঠাকুরপুকুরের লোহারপুলের ৩৪ বছর বয়সি দেবরাজ মণ্ডলও নিজের শরীরকে মন্দিরের মতোই গড়ে তুলেছিলেন। শরীরচর্চা ছিল তাঁর কাছে সাধনা। পরিশ্রমের ফলও পেয়েছিলেন তরতাজা এই তরুণ। ২০১৩ থেকে ২০১৬— টানা চার বছর ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’-র সরকারি খেতাবও জেতেন তিনি। সেই দেবরাজই এখন আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় পান। কারণ তাঁর মন্দির এখন ভেঙে খান খান। যে শরীর দেবরাজের গর্ব ছিল, সেটাই আজ তাঁর প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবল অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে ভারত কাঁপানো এই বডিবিল্ডারের।

২০০৫ সালে জিমে যাওয়া শুরু দেবরাজের। কিছুদিনের মধ্যেই তা নেশায় পরিণত হয়। শরীরচর্চা করতে করতেই কলকাতায় বিভিন্ন বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় নাম দিতে শুরু করেন। কলকাতায় ফল ভাল হওয়ার পরে জেলাস্তরের প্রতিযোগিতাতেও নজর কাড়েন তিনি। তবে শুধু রাজ্যেই নয়, জাতীয় স্তরেও বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করেন দেবরাজ মণ্ডল। ২০১৩ সালে ৬০ কেজি বিভাগে প্রথম হন দেবরাজ। তার পর ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালেও ৬০ কেজি বিভাগে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রকের অধীনে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ খেতাব পান তিনি।

সবকিছু ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত ২০১৬ সালে। চেন্নাই থেকে ফেরার পর দেবরাজের পা অতিরিক্ত ফোলা রয়েছে বলে লক্ষ্য করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। পাশাপাশি তাঁর প্রস্রাব ও খাওয়াদাওয়ার সময়েও বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। তখন বাড়ির কাছেই এক চিকিৎসকের কাছে দেবরাজকে নিয়ে যান পরিবারের লোক। কিন্তু ওই চিকিৎসককে দেখিয়ে সুস্থ না হওয়ায় দেবরাজকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসকেরা জানান যে দেবরাজের দু’টো কিডনিই ৯০ শতাংশ বিকল হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি সমস্যা রয়েছে তাঁর ফুসফুসেও। কিডনি প্রতিস্থাপন করতে গেলে অন্তত ১০ লক্ষ টাকা লাগবে বলে জানান চিকিৎসকরা।

দেবরাজের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। বাড়িতে একটি মুদিখানার দোকান রয়েছে। সুস্থ অবস্থায় একটি জিম সেন্টার খুলেছিলেন দেবরাজ। কিন্তু তিনিই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেটিও এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। দেবরাজের বোন একটি কিডনি দান করতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু কিডনি প্রতিস্থাপনের বিপুল খরচ জোগাড় করা দেবরাজের পরিবারের পক্ষে অসম্ভব।

কেন এমন অবস্থা হল ৩৪ বছরের যুবকের? দেবরাজের পরিবারের সদস্যরা জানাচ্ছেন, পেশিবহুল চেহারা পেতে প্রায়শই অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে সাপ্লিমেন্টারি প্রোটিন নিতেন দেবরাজ। শরীরে প্রোটিনের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গিয়েই মূলত সমস্যার সূত্রপাত। এবং এ কথা চিকিৎসকরাও দেবরাজের পরিবারকে জানিয়েছেন।

পেশাদারি বডি বিল্ডিং না করলেও তরুণ প্রজন্মের অনেকেই এখন আকর্ষণীয় চেহারা পেতে জিমে যান। কোনও বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই অনিয়ন্ত্রিত পরিমাণে সাপ্লিমেন্টারি ফুডও গ্রহণ করেন অনেকে। কিন্তু তাঁর পরিণতি যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ দেবরাজ।

দেবরাজের দাবি, তিনি প্রচুর পরিমাণে মাংস ও ডিম খেতেন। কোথায় সমস্যাটা হল, সেই প্রশ্নের উত্তরই যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘কী থেকে কী হল বুঝতে পারছি না। একটু হাঁটলেই এখন আমি হাঁপিয়ে যাই। চিকিৎসার এত টাকা কোথা থেকে আসবে, এই অবস্থা থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসব, তা মাথায় ঢুকছে না।’’

জাতীয় স্তরে একাধিক সম্মান জেতা দেবরাজ, রাজ্য সরকারের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও আর্থিক সাহায্য পাননি। আপাতত সেই আশাতেই দিন কাটছে তাঁর। একের পরে এক সরকারি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা পাননি। অথচ জাতীয়, রাজ্য স্তরে জেতা একের পর এক পদক, প্রশংসাপত্র তাঁর ঘরে সাজানো।