এবার জনগণের হাতে যৌথ প্রযোজনার সিনেমার ভবিষ্যৎ!

376

অনেক দিন ধরেই যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে রয়েছে। যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘শিকারী’, ‘নবাব’ ও ‘বস-টু’ সিনেমার পোস্টার নিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পী ও কলাকুশলীদের আন্দোলনের মুখে সরকার যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে নতুন নীতিমালার একটি খসড়াও প্রকাশ করা হয়েছে। এই নীতিমালা সম্পর্কে এখন জনসাধারণের মতামত চাওয়া হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের ই-মেইল ঠিকানায় (sas.film@moi.gov.bd) মতামত জানাতে পারবে জনসাধারণ। বেঁধে দেওয়া সময় ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জনগণের মতামত পেলেই সরকার নতুন নীতিমালা প্রকাশ করবে।

রোজার ঈদের আগে চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন চলচ্চিত্র পরিবারের ব্যানারে এক হয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শনও করে। সেই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আপাতত স্থগিত রয়েছে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু তখন বলেছিলেন, নতুন নীতিমালা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মাণ বন্ধ থাকবে। এরপর থেকে সরকার যৌথ প্রযোজনার খসড়া নীতিমালার কাজ দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শাহীন আরা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে যৌথ নীতিমালার খসড়ায় যেসব বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো:

১. পরিচালনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর যৌথ চলচ্চিত্র পরিচালক নিয়োগকে উৎসাহিত করা হবে। তবে সাধারণভাবে যৌথ চলচ্চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রের অভিনয় শিল্পী এবং মুখ্য কারিগরি কর্মীসহ শিল্পী ও কলাকুশলী সমানুপাতিক হারে নিয়োগের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, গায়ক-গায়িকা, সহকারী পরিচালক, নৃত্য পরিচালক, কোরিওগ্রাফার, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, শিল্প নির্দেশক, বিশেষ দৃশ্য পরিচালক, ব্যবস্থাপকসহ চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত অন্য ব্যক্তিরা কারিগরি কর্মী ও কলাকুশলী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

২. বাস্তব কোনো কারণ ও প্রয়োজনে শিল্পী ও কলাকুশলী সমানুপাতিক হারে নিয়োগ না করে কমবেশি করার আবশ্যকতা থাকলে, যৌথ প্রযোজনার আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় যথাযথ যৌক্তিকতা প্রদর্শন করতে হবে। বাছাই কমিটির মতামত সাপেক্ষে মন্ত্রণালয় এ বিশেষ অনুমতি দেবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।

৩. চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের লোকেশন-সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সমানুপাতিক হারে নির্ধারিত হবে। তবে কাহিনি ও চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে এবং বাস্তব কোনো কারণে শুটিংয়ের লোকেশন সমানুপাতিক হারে নির্ধারণ করা না গেলে আবেদনপত্র দাখিলের সময় যথাযথ যৌক্তিকতা প্রদর্শন করতে হবে। বাছাই কমিটির মতামত সাপেক্ষে মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিশেষ অনুমতি দেবে। কাহিনির প্রয়োজনে তৃতীয় কোনো দেশ এবং দেশগুলোতে যৌথ চলচ্চিত্রের চিত্রায়ণ করা যাবে।

৪. বিদেশি কোনো প্রযোজক বা পরিচালক যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা ভঙ্গ করলে পরবর্তী সময়ে তিনি বা তাঁরা বাংলাদেশে যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি পাবেন না।

৫. যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত সব চলচ্চিত্রের যেকোনো প্রচার-প্রচারণায় যৌথ প্রযোজনার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর শিল্পী ও কলাকুশলীদের নাম সমানভাবে ও গুরুত্বসহকারে উল্লেখ থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর শিল্পীর ছবি সমানভাবে প্রদর্শন করতে হবে।

৬. যৌথ প্রযোজনায় নির্মিতব্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য পরীক্ষা ও পর্যালোচনাসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব পরীক্ষা করে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের অনুমোদনের জন্য সুপারিশ বা মতামত দিতে এবং নির্মাণ শেষে চলচ্চিত্র দেখে প্রদর্শনের জন্য চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে দাখিলের ছাড়পত্র দিতে বিএফডিসিতে (বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন) একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হবে। বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবেন এই কমিটির সভাপতি। এ ছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (চলচ্চিত্র), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রয়োজন সমিতির প্রতিনিধি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির প্রতিনিধি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির প্রতিনিধি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রতিনিধি ও সরকারের মনোনীত একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব। বিএফডিসির পরিচালক (উৎপাদন) এ কমিটিতে সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। এই কমিটির প্রস্তাব বিবেচনা করে তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত দেবে।

৭. যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুমতি দেওয়া ও নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিষয়ে বাছাই কমিটির সিদ্ধান্তের বিপরীতে কোনো অভিযোগ থাকলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করতে পারবেন। আপিল আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি আপিল কমিটি থাকবে। তথ্যসচিব হবেন এ কমিটির সভাপতি। সদস্য হিসেবে থাকবেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম বা অতিরিক্ত সচিব ও সরকার মনোনীত চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনজন ব্যক্তি। বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমিটিতে সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। বিএফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়া বাছাই কমিটির অন্য কোনো সদস্য আপিল কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।

৮. যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্রের কাহিনি মৌলিক হতে হবে।

৯. চূড়ান্ত অনুমোদন ও চিত্রায়ণের অনুমোদনের আগে চলচ্চিত্র নির্মাণকাজ ও শুটিং শুরু করা যাবে না। চিত্রায়ণের অনুমতি পাওয়ার পর ন্যূনতম ৭৫ দিন পার না হলে এই চলচ্চিত্র প্রিভিউর জন্য জমা দেওয়া যাবে না।

১০. যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লোকেশনে চিত্রগ্রহণের কমপক্ষে সাত দিন আগে স্থান ও তারিখ উল্লেখ করে বাংলাদেশি প্রযোজকের পক্ষ থেকে বিএফডিসিকে অবহিত করতে হবে। কোনো প্রযোজক বা পরিচালক একই বছরে যেকোনো সংখ্যক যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারবেন।

নতুন খসড়া নীতিমালার পটভূমিতে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। সে সময় ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ও ‘পালঙ্ক’-এর মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয় যৌথ প্রযোজনার আওতায়। সে সময় যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ নিয়মনীতি না থাকলেও পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সমঝোতা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি হয়েছিল ‘পালঙ্ক’। সেই প্রয়াসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল উভয় দেশে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক, নিজ নিজ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সামাজিক বাস্তবতা এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মূল্যবোধ।

‘পরবর্তী সময়ে সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতির আওতায় যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিস্তৃত হয় যৌথ এ প্রয়াসের ক্ষেত্র ও পরিধি। চলচ্চিত্রের বিকাশ ও যৌথ বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। সময়ের প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে এ নীতিমালা কয়েক দফা পরিমার্জন ও সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিস্তৃত হয়েছে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রের উপাদান ও আঙ্গিক। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি এবং অগ্রসর ভাবনা।’

পটভূমিতে বলা হয়, যৌথ প্রযোজনার চলমান প্রয়াসকে বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে আরও বেশি সংগতিপূর্ণ করতে এবং যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ যাতে কেবল অর্থলগ্নী ও লগ্নীকৃত অর্থ থেকে ব্যবসায়িক লাভ অর্জনের মাধ্যমে পরিণত না হয়, এসব বিষয় নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিদ্যমান নীতিমালা যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা থেকে নতুন নীতিমালা করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের ই-মেইল ঠিকানায় (sas.film@moi.gov.bd) ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জনগণের মতামত পেলেই সরকার নতুন নীতিমালা প্রকাশ করবে।